রিক্সায় চিত করে শোয়ানো নিহত নাফিজ এর স্মৃতিচারণ

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের দিকটায় যাওয়া হয়নি আগে, পাপড়ির কল্যাণে যাওয়া হলো। আন্দোলন শুরুর পর থেকে আমি ওর পিছ ধরেছি, ওর সঙ্গে ঘুরি। রিপোর্টিং করতে না পারার স্বাদ ঘোলে মেটাই। আজও এক ই চেষ্টা।

রিকশায় ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ নাফিজের বাড়ি ছিল আমাদের আজকের গন্তব্য। আলপনা আঁকা সিঁড়িতে পা দিয়েই আতর, গোলাপ, আগরবাতির গন্ধ। আজ নাফিজের জন্য মিলাদ ছিল। ঘরে ঢুকতেই বাড়ির পুরুষেরা বেরিয়ে গেলেন, মিলাদের সময় হয়ে এসেছিল।

নাফিজ ফ্লোরে তোশক পেতে ঘুমোত, ওতে বসেছিলেন মা নাজমা আক্তার নাসিমা। বললেন, শরীরটা টানছে না আজ একদম। অনেক কথা বলতে মন চায়, পেরে উঠছেন না। ছেলে চলে যাওয়ার পর ঘুমোননি। আমি পাশে গিয়ে বসলাম, পাপড়ি মুখোমুখি। নাজমা বললেন, তাঁর ছোটো ছেলেটা ওইটুকুন বিছানায় তিনটে বালিশ নিয়ে ঘুমোত। এস এস সি অব্দি মায়ের ঘরেই পড়েছে, ছোট্ট ভাড়া বাসা। কলেজে ওঠার পর একটা টেবিল কিনে দেওয়া হয়েছিল।

সেদিনও (নিহত হওয়ার দিন) বাড়ি থেকে বেরুনোর আগে ওই চেয়ারে বসেই পড়ছিল, আর হাতে তার সেই নীল রং এর বল, একটু অস্থির ছিল ওদিন। এর আগে পর্যন্ত আন্দোলনে যেতে বাধা দেননি নাজমা, যেদিন ও চলে যায় সেদিন মন সায় দিচ্ছিল না। ছেলে বাসা থেকে বেরোলে মাকে বলে যায়নি, এমন হয়নি।‌ সেদিন চুপচাপ বেরিয়ে গেছে। ঘন্টা দুয়েক বাদে বন্ধুর ফোন থেকে মাকে নাফিজ জানিয়েছিল সে ভালো আছে, চিন্তা না করতে। নাজমা তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন তাঁর কিছু ভালো লাগছে না। ছেলে তবু এলো না, সন্ধ্যে হয়হয়। নাজমা নামাজের পাটিতে বসলেন, ছেলে যেন ফিরে আসে আল্লাহর দরবারে হাত ওঠালেন।

নাহ কোনো জায়গা থেকে কোনো সাড়া নেই। এবার নাফিজের বাবা মা, আর মামা মামী ভাগ হয়ে তাকে খুঁজতে বেরোলেন। ঘোর কারফিউ, ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। নাহিদের বড় ভাই নাদিম বাসায়, নাফিজ এর মধ্যে ফিরে এলে ঘরে ঢুকবে কি করে সেই চিন্তা থেকে বড় ভাই নাদিমকে বাসায় রেখে গেছেন বাবা মা। এর পর সরকারি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি, ক্যাজুয়ালটিতে একজন একজন করে দেখা, যদি নাফিজ থাকে ওদের মধ্যে। এর মধ্যেই নাফিজের মামীকে ফোন দেয় নাদিম। নাফিজের পরনে যে গেঞ্জি, সেই গেঞ্জি পরা একটা ছেলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রিক্সায় এমন একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। মামীর বিশ্বাস হয়নি, তবু সোহরাওয়ার্দীর মর্গে গেলেন ওরা, দেখলেন নাফিজের মরদেহ। নাফিজের বাবা মাও ঢাকা মেডিকেল থেকে ততক্ষণে সোহরাওয়ার্দীতে।

নাফিজের মা নাজমাকে যখন লাশঘরের সামনে নেওয়া হয়েছে, তখন তিনি বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। নাফিজের বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শক্ত থাকবেন। লাশঘরের সহকারী কাফনের কাপড়টা সরিয়ে নাফিজকে দেখালেন। বাবা দেখলেন, ছেলের বুকের ঠিক মধ্যখানে গুলি। মর্গ সহকারী তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে এবার ওর পিঠের দিকটা দেখালেন। বুকের মাঝখান থেকে ছোট গুলিটা ঢুকে পিঠের অনেকটা অংশ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি বাবা, ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আহারে নাফিজ, আমি কোনোদিন তোমার গায়ে হাত তুলিনি বাবা!

ওখান থেকে বেরিয়ে দ্রুততার সঙ্গে নাফিজের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ওদের দক্ষিণখানের বাসায়। এই বাবাই তাঁর ১৭ বছরের ছেলেটাকে গোসল করিয়ে কবরে নামেন। মুখের বাঁধন আলগা করে মাটি চাপা দেন। ভদ্রলোকের দুটো দোকান ছিল। খুইয়েছেন দুটোই। ছোটখাটো ব্যবসা করে কোনোরকমে জীবন পার করছিলেন ছেলে দুটোর মুখের দিকে চেয়ে, দুটি ছেলেই মেধাবী। নাজমা বলছিলেন, কোনোরকমে ডাল ভাত জুটাতে পারতাম, এর বেশি কিছু না।

ছেলে ভালো রেজাল্ট করলে বুক ভরে যেত। কোনো কষ্টকেই কষ্ট মনে হতো না। আমি আলগোছে নাহিদের মামীকে একটা প্রশ্ন করলাম বেহায়ার মতো। আচ্ছা ছেলের মুখ দেখে কি করেছিলেন উনি। জবাব ছিল, অনেকদিন বাচ্চাকে না দেখলে মায়েরা যেমন করে তেমন। চোখে, গালে চুমু খাচ্ছিলেন পাগলের মতো।

নাজমা এখন কী নিয়ে বাঁচবেন জানেন? নাহিদের স্মৃতি নিয়ে। ছেলেটাও স্মৃতি আঁকড়ে ই থাকত। তার নীল বল, ছোটো ছোটো গাড়ি, পাজল, কলম সব গুছিয়ে রেখেছিল। ফেলতে দিতে না। ছোট ছেলেটা বড় হ ওয়ার সুযোগ পেল না। নাজমা বললেন, তাঁর বাচ্চাটা বড় হয়ে গেছে বুঝতে পেরেছিলেন তাকে খাটিয়ায় তোলার পর।

খাটিয়া জুড়েই ছিল ছেলেটা…

ফেইসবুকে লিখেছেন গনমাধ্যম কর্মী – Sheikh Sabiha Alam

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *