ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে উপার্জনের যত মাধ্যম রয়েছে, তার মধ্যে ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে সবচেয়ে চাহিদাপূর্ণ ক্ষেত্র। মূলত বিশ্বের ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রায় সবাই ক্রমেই ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সবাই চাচ্ছে, তার একটি ভার্চুয়াল ঠিকানা হোক। কারণ একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান একদিকে যেভাবে তার গ্রাহকদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, অপরদিকে বিভিন্ন শহরে বা বিভিন্ন দেশে অবস্থিত নিজস্ব শাখার সাথে আত্মযোগাযোগও সহজে এবং কম খরচে করতে পারে।
বর্তমানে একটি ডেস্কটপ সফটওয়্যার তৈরি করার চাইতে ওয়েবসাইট তৈরির করতে সবাই বেশি আগ্রহী থাকে। একারণে, ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টের কাজই সর্বাধিক। একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট তৈরি করার সময় কাজগুলোকে দুইভাবে ভাগ করা হয় যায়, একটি হচ্ছে ওয়েবসাইটির বাহ্যিক অবয়ব তৈরী করা এবং অন্যটি ওয়েবসাইট কিভাবে কাজ করবে তার নির্দেশনা দেয়া। বাহ্যিক অবয়ব তৈরী করাকে ওয়েব ডিজাইনিং বলে এবং ওয়েবসাইট কিভাবে কাজ করবে তার নির্দেশনাকে ওয়েব প্রোগ্রামিং বলা হয়। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে একটি ওয়েবসাইট ডেভেলাপ বা তৈরি করা হয় এবং এই প্রক্রিয়াকে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বলে।
ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডিজাইনিং
একটি ওয়েবসাইট তৈরীতে প্রথমেই বাহ্যিক অবয়ব তৈরী করতে হয়, অর্থাৎ ওযেবসাইটটি দেখতে কেমন হবে সেটির ডিজাইন করতে হয়। ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রেও কয়েকটা ধাপ রয়েছে:
১. ফটোশপ দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাফিক্স যেমন বাটন, ব্যানার, বিভিন্ন ধরনের টেবিল, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি বানানো।
২. বাটন, ব্যানার ইত্যাদি গ্রাফিক্সের সংমিশ্রণে পিএসডি টেমপ্লেট বানানো।
৩. সেটা এইচটিএমএল ও সিএসএস এ রূপান্তর।
কেউ এইচটিএমএল ও সিএসএস এ রূপান্তর করতে না পারলে তাকে ওয়েব ডিজাইনার না বলে ওয়েব গ্রাফিক্স ডিজাইনার বলা হয়ে থাকে। ওয়েব গ্রাফিক্স-এর কাজ থাকলেও মার্কেটপ্লেস পর্যালোচনা করে দেখা যায় একজন ওয়েব ডিজাইনারই বেশি কাজ পেয়ে থাকে ওয়েব গ্রাফিক্স ডিজাইনারের চেয়ে। পুরোপুরি ওয়েব ডিজাইন এ দক্ষ ফ্রিল্যান্সারকে মার্কেটপ্লেসগুলোতে এখন ফ্রন্ট এন্ড ডেভেলপার বলা হয়। ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলোতে ওয়েব ডিজাইনিং কাজ করতে হলে যে জিনিসগুলো জানতে হবে ফটোশপ, এইচটিএমএল, সিএসএস। জাভাস্ক্রিপ্ট ও ফ্ল্যাশ জানা থাকলে ভালো।
ফ্রিল্যান্স ওয়েব প্রোগ্রামিং
একজন ওয়েব ডিজাইনারের স্ট্যাটিক ডিজাইনিং এর পরই কাজ শেষ হয়ে যায় কিন্তু তার তৈরি করা ডিজাইনকে ওয়েবে ব্যবহার যোগ্য বা ডাইনামিক করে তোলেন একজন ওয়েব প্রোগ্রামার। এক্ষেত্রে একজন ওয়েব প্রোগ্রামারকে মাঝে মাঝে ডেভেলপারও বলা হয়ে থাকে। তাঁকে গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন ওয়েবসাইট নির্ভর অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে দিতে হয়। এক্ষেত্রে মার্কেটপ্লেসগুলোতে এরা ব্যাক এন্ড ডেভেলপার নামে পরিচিত। যারা কম্পিউটার সায়েন্স, আইটি বা এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা করেছে তারা ওয়েব প্রোগ্রামিং করে থাকেন। তবে অনেকেই আছেন যারা শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় প্রোগ্রামিং শিখে বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থায় আছেন।
একজন ফ্রিল্যান্স ওয়েব প্রোগ্রামার হতে যে দক্ষতার প্রয়োজন
১. ক্লায়েন্ট সাইড প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ। যেমন জাভাস্ক্রিপ্ট- এটাকে ব্রাউজার স্ক্রিপ্টিংও বলা হয় অর্থ্যাৎ এই ল্যাংগুয়েজ দিয়ে লেখা কোড শুধু কোন ব্রাউজারে কাজ করবে।
২. সার্ভার সাইড প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ। বিভিন্ন ধরনের সার্ভার সাইড প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ রয়েছে। এর মধ্যে PHP, Python, Perl, Ruby, JSP, ASP উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেকটা ল্যাংগুয়েজ এর বিশেষ কিছু ফিচার থাকলেও সবগুলোর কাজ প্রায় একই ধরনের। একটি ল্যাংগুয়েজ পারলেই অন্য গুলো কিছুদিন অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্তে আনা যায়। সব প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ এর সিনট্যাক্স আলাদা কিন্তু লজিক এক।
৩. ডেটাবেস: ডেটাবেইজ হিসেবে MySQL, MS SQL, PostgreSQL ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। একটি ওয়েবসাইটের ব্যবহারকারীর তথ্য এবং অন্যান্য তথ্য ডেটাবেস এ সুবিন্যস্তভাবে রাখা হয়। যখনি কোন তথ্যের দরকার পড়ে সংরক্ষিত ডেটাবেস থেকে তা পাওয়া যায়। ডেটাবেসের সাথে সংযোগকরনই স্ট্যাটিক আর ডাইনামিকের ওয়েবসাইটের অন্যতম পার্থক্য।
৪. ফ্রেমওয়াক: ফ্রেমওয়ার্ক হচ্ছে আগে থেকেই বানানো নির্দিষ্ট কোন কাজের সমষ্টি, যেটা ব্যবহারের ফলে কম সময়ে এবং একই কাজ বারবার করা না লাগে। কোন ফ্রেমওয়ার্ক ছাড়াও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন তৈরী করতে পারবেন তবে এতে বেশি সময় লাগবে এবং বেশি কোড লিখতে হবে। PHP এর ফ্রেমওয়ার্কগুলোর মধ্যে Zend, Codignator, CakePHP উল্লেখযোগ্য, Dot Net আবার Python এর জন্য Django বিখ্যাত। আসলে একজন ওয়েব ডেভেলপার বা প্রোগ্রামার তার গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে এবং নিজের দক্ষতার উপর কোন ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
৫. সিএমএস: কনটেন্ট মেনেজম্যান্ট সিস্টেমের ছোট রূপ সিএমএস। সাধারণত একজন গ্রাহক যাতে নিজের ওয়েবসাইট নিজেই আপডেট করতে পারে সেজন্য সিএমএস এর ব্যবহার হয়। সাধারন ব্যবহারকারীর কোনরকম প্রোগ্রামিং জ্ঞান ছাড়াই তিনি সেটা ব্যবহার করতে পারেন। তাই বর্তমানে ওয়েব ডেভেলাপমেন্ট এ সিএমএস এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। সিএমএস-এর মধ্যে ওয়ার্ডপ্রেস, দ্রুপাল, জুমলা, ম্যাজেন্টো এবং ওএস কমার্স সবচেয়ে জনপ্রিয়। ছোট ও মাঝারি ওয়েবসাইট বানাতে এখন ম্যানুয়াল কোডিং এর বদলে সিএমএস ব্যবহার করা হয়।
ওয়েব প্রোগ্রামিং না ডিজাইন?
নিজে নিজে প্রোগ্রামিং শেখাটা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি প্রোগ্রামিং ভাষা শেখা থেকে শুরম্ন করে তাতে পরিপূর্ণ দক্ষ হতে বছরখানেক সময় লেগে যেতে পারে। অন্যদিকে ওয়েবসাইট ডিজাইন তুলনামূলকভাবে ততটা সময়সাপেক্ষ নয়, ব্যক্তিভেদে তিন থেকে ছয় মাস সময় লাগতে পারে। আয়ের দিক থেকে ওয়েবসাইট প্রোগ্রামিং পরই ওয়েবসাইট ডিজাইনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়েবসাইট ডিজাইন শেখার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ইন্টারনেটে এই বিষয়ে যে পরিমাণ টিউটোরিয়াল রয়েছে তা থেকে ঘরে বসে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই ডিজাইনিং শেখা সম্ভব। তবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে হাতে কলমে শিখলে অনেক দ্রুত শেখা যায় এবং ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা সহজেই বোঝা যায়।
কোথায় শিখবেন?
ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট যেহেতু ব্যাপক একটি বিষয়, তাই কিছু সময় নিয়ে এবং চিন্তা করে অগ্রসর হওয়া উচিত।
উল্লেখ্য ইতোমধ্যে আমাদের দেশে অনেক প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্সাররা অন্যদের সুযোগ করে দিতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিখিয়ে থাকেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন শর্টকোর্সও হয়ে থাকে। আবার একটা কথা বলা যায়, যেহেতু প্রত্যেকটা জিনিস নিজস্ব সাধনার বিষয়, কোথাও থেকে ওয়েব ডিজাইনের উপর দু-তিন মাসের একটি কোর্স করে আপনি প্রফেশনাল ওয়েব ডিজাইনার হয়ে গেছেন, তা কিন্তু নয়। বরং বেসিক কমান্ড শেখার পর তার উপর বিভিন্ন প্রজেক্ট প্র্যাকটিস করার মাধ্যমেই প্রফেশনালি দক্ষ হওয়া সম্ভব। এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের ডিজাইন দেখে অনুরূপ ডিজাইন তৈরির চেষ্টা করতে হবে। ডেভসটিম ইনস্টিটিউট ওয়েব ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্টের ওপর আলাদা আলাদা কোর্স অফার করে, তাঁদের প্রশিক্ষণগুলোও দেখতে পারেন। তাঁদের প্রশিক্ষণগুলো মানসম্মত এবং রেকমেন্ডেড।
মার্কেটপ্লেসের বর্তমান চাহিদা
প্রথমেই বলে এসেছি ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেগুলোতে সব থেকে বেশি কাজ পাওয়া যায় ওয়েব ডেভেলাপমেন্টের। নিচে জনপ্রিয় কয়েকটি ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে ওয়েব ডেভেলাপমেন্টের কাজের বর্তমান চাহিদা দেখানো হল:
আপওয়ার্ক: বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক এর প্রায় ৩৫ শতাংশ কাজ হচ্ছে ওয়েব ডেভেলাপমেন্ট’র। “The State of the Freelance Report” অনুযায়ী আগামী বছর আপওয়ার্ক এর ওয়েব প্রোগ্রামিং ক্যাটেগরিতে কাজ বাড়বে ৫০ শতাংশ এবং ওয়েব ডিজাইনিং ক্যাটেগরিতে কাজ বাড়বে ৪১ শতাংশ। তাছাড়া ফ্রিল্যান্সার ডটকম, গুরু ডটকম এবং অন্যান্য বড় বড় মার্কেটপ্লেসগুলোর পোস্টকৃত কাজের প্রায় ৩০ শতাংশ বা তার উপরে ওয়েব ডেভেলাপমেন্টের কাজ রয়েছে।
এনভাটো মার্কেটপ্লেস: মূলত এই মার্কেটপ্লেস এ কোন কাজ না পেলেও আপনার বানানো সুন্দর সুন্দর পণ্য (ওয়েব টুলস) বিক্রি করতে পারেন। ভার্চুয়াল দোকানও বলা হয়ে থাকে এনভাটোর ওয়েব রিলেটেড পণ্যের মার্কেটপ্লেস মূলত ২টা, থিমফরেস্ট themeforest.net ও গ্রাফিক্রিভার graphicriver.net। থিমফরেস্টে বিক্রি করা হয় ওয়েব টেমপ্লেট এবং বিভিন্ন সিএমএস এর থিম, গ্রাফিক রিভারে বিক্রি করা হয় বিভিন্ন ওয়েব এলিমেন্ট। এই মার্কেটপ্লেসগুলোর নিয়ম অত্যন্ত পেশাদারি হওয়ায় এখানে অনেক কষ্ট করে একটা পণ্য স্থান পাওয়াতে হয়। যদি কেউ অন্তত দক্ষ হয় তবে তাকে থামাতে পারে না। থিমফরেস্টে U- Design নামের একটি ওয়ার্ডপ্রেস থিম ৫৯ ডলার দামে বিক্রি হয়েছে ৫৪ হাজার ৩ শ ২১ বার, যার ৭০ শতাংশ ডেভলপার পেলে মোট আয় ২২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭ ডলার। যদিও এত বেশি আমাদের প্রত্যাশা নয় তবুও আমাদের মেধা কাজে লাগিয়ে অন্তত-এর কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব।
সবশেষে, রাস্তা আমাদের জন্য বানানো- যাত্রীও রেডি কিন্তু চালক আর গাড়ির অভাব। ডাটা এন্ট্রি আর পিটিসি বা ছোট ও সহজ স্কিলের কাজ না করে আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ওয়েব ডেভলপমেন্টে অগ্রসর হই তবে শুধু টাকা রোজগার নয় একই সাথে দেশের সুনাম এবং নিজের সুনামও সম্ভব।
লেখকঃ মৃণাল কান্তি রায় দীপ
ফ্রিল্যান্স ওয়েব ডেভেলপার।
আরো পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং স্মার্ট ক্যারিয়ার | আল্টিমেট গাইডলাইন পার্ট ১
অনলাইনে আয়ের সেরা ১০ উপায় | ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং আল্টিমেট গাইডলাইন পার্ট ২
গ্রাফিক্স ডিজাইন কি | কিভাবে শিখবেন | ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং আল্টিমেট গাইডলাইন পার্ট ৩