ইনসুলিন কি, ইনসুলিনের ধরণ ও এর ব্যবহার

যাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে তাদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস এর পরিমান কম তাদের ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। যাদের ডায়াবেটিস এর মাত্রা বেশি তাদের মাত্রা অনুযাইয়ী ডাক্তার ঔষধ ও ইনসুলিন নেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডায়াবেটিসের মাত্রার উপর ভিত্তি করে আবার ইনসুলিন ও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে প্রধানত  দুই ধরণের ইনসুলিন ব্যবহার করা হয়ঃ

১। স্বচ্ছ, নিয়মিত বা স্বল্প মেয়াদী ইনসুলিন (Regular Insulin) (হিউমোলিন আর, ইনসুমান র‍্যাপিড ইত্যাদি) এবং

২। ঘলাতে বা মধ্য মেয়াদী ইনসুলিন (Intermediate Insulin) হিউমোলিন –এন, ইনসুমান ভেজাল ইনসুলেটার্ড ইত্যাদি) 

প্রথমটি দেখতে পানির মত স্বচ্ছ, কাজ আরম্ভ করে ইনজেকশন দেবার ৩০ মিনিট পরে, ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে  এটি সবচেয়ে বেশী কাজ করে এবং এর কাজের স্থিতিকাল ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা।

দ্বিতীয় দেখতে ঘোলাটে; এর কাজ আরম্ভ হই ইনজেকশন দেবার দেড় ঘণ্টা পড়ে। এটি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী কাজ করে। এর কাজের স্থিতিকাল ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। 

অন্যান্য ইনসুলিন

প্রিমিক্সিড ইনসুলিন(Premixed Insulin): এই ইনসুলেনের বোতলে স্বচ্ছ এবং ঘোলাটে ইন্সুলেনের বিভিন্ন নির্দিষ্ট অনুপাতে থাকে। যেমন- ৩০:৭০; ২৫:৭৫; ৫০:৫০; ৪০:৬০ ইত্যাদি। আদের কাজ শুরু হয় ৩০ মিনিটে এবং কার্যকারিতা থাকে ১৮-২০ ঘণ্টা যথা-

ক) ইনসুলিন মিক্সটার্ড ৩০:৭০; ৫০:৫০  খ) ইনসুলিন ইনসুমান ২৫:৭৫  গ) হিউমুলিন ৭০:৩০ ইত্যাদি।

উল্লেখিত ইনসুলিন গুলো খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে নিতে হবে।

সাম্প্রতিক ইনসুলিন

১। ইনসুলিন এনালগ- দ্রুত কার্যকরী (Rapid Acting Analogues)

ক) ইনসুলিন এসপার্ট (নভো রেপিড) খ) ইনসুলিন লিসপ্রো (হিউমালগ)

এই ইনসুলিন ১০-১৫ মিনিটে রক্তে আসে এবং এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ কাজ শুরু করে। স্থায়িত্ব কাল ৩-৪ ঘণ্টা। এই ধরণের ইনসুলিন খাওয়ার আগে আগে বা খাওয়ার পর পর দেয়া যেতে পারে।

২। ইনসুলিন এনালগ দীর্ঘ মেয়াদী (Long Acting Analogues)

ক) ইনসুলিন গ্লারজিন (ল্যান্টাস)   খ) ইনসুলিন ডিটেরিম (লেভেমির)

এই ইনসুলিন কাজ শুরু করে ১ ঘণ্টায়। স্থায়িত্ব কাল ২৪ ঘণ্টা। এই ধরণের ইনসুলিন দিনে একবার নির্দিষ্ট সময়া দেয়া যেতে পারে। বেশীর ভাগ ক্ষত্রে রাতে নির্দিষ্ট সময়ে দিলে ভাল। খাবারের সাথে কোন সম্পর্ক নাই। 

৩। প্রিমিক্সড এনালগ (Premixed Analogues)

ক) ইনসুলিন এসপার্ট মিক্স (নভো মিক্স-৩০)   খ) ইনসুলিন লিসপ্রো মিক্স (হিউমালগ ২৫, হিউমালগ ৫০)

এই ইনসুলিন কাজ শুরু করে ১৫ মিনিটে। স্থায়িত্ব কাল ২৪ ঘণ্টা।

ইনসুলিন সংরক্ষন এর নিয়ম

ইনসুলিন ঠান্ডা জায়গায় রাখা প্রয়োজন। না হলে আর কার্যক্ষমতা কমে যায়। এক মাসের বেশী সময় রাখতে হলে ফ্রিজে ২° থেকে ৮° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যেখানে ফ্রিজ নেই বা যাদের বাসায় ফ্রিজ নাই তারা মাঝারী আকারের একটি মাটির হাড়িতে পরিষ্কার কাপড়ে ইনসুলিনের বোতল পেঁচিয়ে হাড়ির ঢাকনি বন্ধ করে অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা জায়গায় রাখবেন। ফ্রিজ না থাকলে এক মাসের প্রয়োজনের বেশী ইনসুলিন না কেনাই বাঞ্ছনীয়। 

ইনসুলিন দেওয়ার নিয়ম ও পদ্ধতি


ইনসুলিন দেওয়ার নিয়ম ও পদ্ধতি
  • প্রথমে দেখে নিন ইনসুলিনের বোতলের ক্যাপ ঠিক আছে কিনা এবং বোতলের গায়ে এর কার্যক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার যে তারিখ লেখা আছে, তা অতিক্রম করেছে কিনা। লক্ষ করুন প্রতি মিলি লিটারে কত ইউনিট ইনসুলিন আছে – ৪০ ইউনিট না ১০০ ইউনিট। সেই হিসেবে ইনসুলিন সিরিজ ব্যবহার করুন।
  • ইনজেকশন নেবার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ( সিরিজ, পরিষ্কার জিবানু মুক্ত তুলা ইত্যাদি) হাতের কাছে রাখুন।
  • সাবান ও পানি দিয়ে হাত ভাল ভাবে ধুয়ে নিন।
  • দুই হাতের তালুর মাঝে ইনসুলিনের বোতল ধরে ভালভাবে ঘুরিয়ে নিন। তবে জরে ঝাঁকুনি দিবেন না।
  • বোতলের রাবার ক্যাপ স্পিরিট দিয়ে মুছে নিন এবং বাতাসে তা আপনা আপনি শুকিয়ে নিন।
  • যতটুকু ইনসুলিন দরকার সেই পরিমান বাতাস সিরিঞ্জের মধ্যে তেনে নিন। মনে রাখবেন ৪০ ইউনিটের জন্য ৪০ ইউনিট সিরিঞ্জ এবং ১০০ ইউনিটের জন্য ১০০ ইউনিট সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
  • এবার সুঁচ বোতলের মুখের রাবারের মাঝখান দিয়ে ভিতরে ঢোকাতে হবে। আপনার হাত যেন সুচের কোন অংশে না লাগে।
  • সিরিঞ্জের বাতাস বোতলে ঢুকিয়ে দিন।
  • এখন সুঁচ সহ বোতলটি উল্টো করে ধরুন। দেখবেন এমনিতেই সিরিঞ্জে পরিমান মত ইনসুলিন আসে গিয়েছে। প্রয়জনে হালকা টান দিয়ে বাকী ইনসুলিন সিরিঞ্জে টেনে নিন।
  • সিরিঞ্জে যেন বাতাস বা বুদবুদ না থাকে সে বিষয়ে লক্ষ করুন। বাতাস বা বুদবুদ থাকলে তা বোতলের ভিতর ঢুকিয়ে দিন আবার টানুন।
  • এবার ইনসুলিন সহ সিরিঞ্জ তেনে বের করুন এবং রোগীকে ইনজেকশন দিন।
  • যে স্থানে ইনজেকশন দিবেন সেই স্থানে জীবাণু মুক্ত তুলা দিয়ে ভালভাবে পরিষ্কার করুন।
  • ইনজেকশন দেবার স্থানটির চামড়া তেনে ধরে ৪৫ থেকে ৯০ কোনাকুনি ভাবে সুঁচ ঢুকিয়ে দিন। চামড়া পাতলা হলে ৪৫ চামড়া মোটা হলে ৯০।
  • খেয়াল করুন ইনসুলিন চামড়া এবং মাংশপেশির মাঝের ফাকা স্থানে (চামড়া এবং মাংশপেশির মধ্যে নয়) পৌঁছাতে হবে।
  • ইনসুলিন ইনজেকশন দেবার স্থানগুলো হল দুই বাহুর বাইরের দিক, দুই উরুর সাম্নের দিক, দুই নিতম্বে এবং তল পেটের নিচের দিকের দুই পাশে।
  • প্রতিদিন একই স্থানে ইনজেকশন দেওয়া ঠিক নয়। এমন ভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যেন এক মাসের মধ্যে একই স্থানে দুই বার ইনজেকশন না পড়ে। 

একই সিরিঞ্জে স্বচ্ছ ও ঘোলাটে ইনসুলিন টানার নিয়ম

  • প্রথমে যতটুকু ঘোলাটে ইনসুলিন দরকার ততটুকু বাতাস ঘোলাটে ইনসুলিনের বোতলে ঢুকিয়ে সিরিঞ্জের সুঁচ টেনে বের করে নিন। 
  • এবার যতটুকু স্বচ্ছ ইনসুলিন দরকার সেই পরিমান বাতাস স্বচ্ছ ইনসুলিনের বোতলে ঢুকিয়ে সমপরিমাণ ইনসুলিন সিরিঞ্জে টেনে নিন।
  • সুঁচ সহ স্বচ্ছ ইনসুলিন ভর্তি সিরিঞ্জ টেনে বের করুন।
  • এবার সুঁচ ঘোলাটে ইনসুলিনের বোতলে ঢুকান এবং বোতল উল্টা করে ধরুন। দেখবেন ইনসুলিন এমনিতেই সিরিঞ্জে আসে গেছে এবার ইনসুলিন সহ সিরিঞ্জ ও সুঁচ টেনে বের করুন। 
  • বেশী নড়াচড়া না করে তাড়াতাড়ি ইনজেকশন নিয়ে নিন। 

আজকাল প্লাস্টিকের তৈরি সম্পূর্ণ জীবাণু মক্ত সিরিঞ্জের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও এই সিরিঞ্জ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেবার নিয়ম, তবে যদি সুঁচ ও পিস্টন হাত বা তুলা দিয়ে না ছোঁয়া হয় তাহলে এই সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করার প্রয়োজন হয় না। সেই কারণে একজন রোগীর দেহে তা একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।

ইনসুলিনের লেভেলের রং দেখেও ইনসুলিন চেনা যায়

ইনসুলিনের নাম ও রং এর নাম

রং

নিয়মিত রং- হলুদ

মধ্য মেয়াদী- হালকা সবুজ-

পূর্ব মিশ্রিত (৩০ঃ৭০) – বাদামী

পূর্ব মিশ্রিত (৫০ঃ৫০) – ধূসর

দ্রুত কার্যকরী এনালগ- কমলা

দীর্ঘমেয়াদী এনালগ- সবুজ

পূর্ব মিশ্রিত এনালগ- কালচে নীল 

আশাকরি এই লেখাটি পরে আপনারা ডায়াবেটিস রোগে ইনসুলিন ও ইনসুলিন এর ব্যবহার সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা পেয়েছেন। ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কে আমাদের সাইটে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করব যেন আপনারা উপকৃত হন।

সোর্সঃ https://dtc.ucsf.edu/types-of-diabetes/type2/treatment-of-type-2-diabetes/medications-and-therapies/type-2-insulin-rx/types-of-insulin/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *