চুল পেকে যাওয়া মানুষের জীবনচক্রের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সাধারণত মানুষের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে চুল পাকতে শুরু করে। আবার জাতি-গোস্টীর ভিন্নতায় জন্ম থেকে নানা মানুষের চুল এর রঙ নানা রকম হয়ে থাকে। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের সাধারণত ৩০ বছর বয়সের পর চুল পাকা শুরু হয়। এই বয়সের আগে চুল পাকলে তাকে অকালপক্ব চুল বলা হয়। প্রায়ই দেখা যায় আমাদের আশেপাশে অনেক কম বয়সী নারি পুরুষের চুল পেকে যায়। সাধারণত মাথার চামড়ায় পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল এর অভাবে চুল পাকতে পারে। কম বয়সে চুল পাকার ফলে অনেকেই অস্বস্তিতে ভোগেন, বিশেষ করে নতুন কোন যায়গায় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে। আজকে আমরা আলোচনা করব অল্প বয়সে চুল পাকার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে।
অল্প বয়সে চুল পাকার কারণ
অল্প বয়সে চুল পাকার জন্য বংশগত কারণ অন্যতম। অল্প বয়সে চুল পাকার জন্য জেনেটিক বা বংশগত সম্পর্ক রয়েছে। পূর্বপুরুষের মধ্যে অকালে চুল পেকে যাওয়ার ইতিহাস থাকলে এমনটা হতে পারে। সেজন্যই কারো কারো ক্ষেত্রে চুল অন্যদের তুলনায় আগে পাকা শুরু করে।
হরমোনের সমস্যায় অকালে চুল পাকতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজম ও হাইপারথাইরয়েডিজম এই দুই সমস্যায়ও চুল অকালে পাকতে পারে। এছাড়াও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে, শ্বেতি, আ্যলার্জি, পরিপাকতন্ত্রের রোগ, রক্ত শূন্যতা, প্রোজেরিয়া ও প্যানজেরিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হলেও কম বয়সে চুল পাকতে পারে।
মানসিক অবসাদ, মানসিক চাপ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা থেকে অকালে চুল পাকতে পারে। তারুণ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে সেরেটনিন হরমোন অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। মানসিক অবসাদ রক্তে সেরটনিন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। পরিণামে ত্বক ও চুলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। সেরেটনিন হরমোন মানসিক উৎকর্ষের জন্যও কাজ করে। যত বেশি মন উৎফুল্ল থাকে, ইতিবাচক চিন্তা বেশি করবেন, তত সেরেটনিনের মাত্রা বেশি থাকে।
ভিটামিনের অভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফোলেট, ভিটামিন বি–১২, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডির অভাবে অকালে চুল পেকে যায়। ভিটামিন সি–জাতীয় খাবারের মধ্যে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে, যা ত্বক, চুলের পুষ্টি জোগাতে সাহায্য করে। অপুষ্টি, ভিটামিন, মিনারেলের অভাবে অনেকের চুল অকালে পেকে যায়।
অতিরিক্ত রাসায়নিক যুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার করলে, চুল অতিমাত্রায় ডাই ও রং ব্যবহার করলেও চুল অকালে পাকতে পারে। তাছাড়া সব প্রসাধনী সব বয়সের মানুষের জন্য উপযোগী নয়।
ভেজাল খাবার, পরিবেশদূষণের জন্যও চুল পাকতে পারে। অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড, উচ্চমাত্রার প্রোটিন, অতিমাত্রায় কোমল পানীয় ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং বয়স অনুযায়ী ওজন বেশি থাকলেও চুল অকালে পাকতে পারে।
কিছু অটোইমিউন ডিজিজে চুল সাদা হয়ে যায়। এ ধরনের রোগের মধ্যে ভিটিলিগো অন্যতম।
কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপিসহ কিছু ওষুধের প্রতিক্রিয়ার ফলেও চুল পেকে যায়।
এটিও পরতে পারেনঃ গরমে চুলের যত্ন নেওয়ার উপায়
চুল পাকা প্রতিরোধের উপায়
আমলকী ও লেবু শরীরের মেদ কমানো, হৃদপিন্ডের সমস্যা ইত্যাদি আভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি চামড়ার ইনফেকশন এবং মাথার চামড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে এই দুটো ফলের জুড়ি নেই। তাই অকালে চুল পাকা রোধের জন্য আমলকির গুঁড়া কিনে এনে তা লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে ২-১ দিন পর পর ১ ঘণ্টা করে মাথার চামড়ায় ম্যাসাজ করুন, তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেললে ভাল উপকার পাওয়া যায়।
পেঁয়াজ বাটা চুল পাকা রোধে অত্যন্ত কার্যকরী ভুমিকা রাখে। পেঁয়াজ ভালোমত বেটে নিয়ে প্রতিদিন কিছুক্ষণ মাথার চামড়ায় ও চুলে ম্যাসাজ করে ৩০ মিনিট পর ধুয়ে ফেললে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পাকাচুল কালো হয়ে যাবে। তবে দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য অবশ্যই প্রতিদিন একবার করে এই উপায় অনুসরণ করতে হবে।
চুলের যত্নে নারিকেল তেলের কোন জুড়ি নেই, আর লেবুর গুণাগুন তো আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৪ চা চামচ নারিকেল তেল এর সাথে আড়াই চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে উক্ত মিশ্রণ প্রতিদিন চুলের গোড়ায় এবং মাথার চামড়ায় লাগান। দুই সপ্তাহের মধ্যেই পাকা চুল কালো হয়ে উঠবে।
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারাল এর একটা সিংহভাগ গাজর একাই পূরণ করতে পারে। চুলের যত্নেও গাজর বেশ কার্যকরী। গাজরের সাথে পানি, চিনি মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিয়মিত পান করুন। প্রতিদিন অন্তত একগ্লাস করে গাজরের রস পান করলেই আপনার পাকা চুলের প্রতিকার পাওয়া শুরু করবেন।
স্কিন ডাক্তাররা চুলের যত্নে মাঝে মধ্যে তিলের বীজ এবং বাদাম তেল এই চিকিৎসাটি প্রেসক্রাইব করে থাকেন। প্রথম তিল বীজ গুঁড়ো করে নিন, এরপর তা বাদাম তেলের সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরী করুন। এই পেস্টটি চুলে ও মাথার চামড়ায় লাগিয়ে ২০-৩০ মিনিট রেখে দিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চিকিৎসায় সবচাইতে বেশি উপকার পাওয়া সম্ভব।
জাংক ফুড, ফাস্ট ফুড, অতিমাত্রায় কোমল পানীয়, মাদকদ্রব্য, ধূমপান ইত্যাদি বর্জন করতে হবে।
মৌসুমি ফল, শাকসবজি নিয়মিত খেতে হবে। সবুজ–হলুদ ফলের মধ্যে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে উচ্চমাত্রায়, যা তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করতে হবে।
মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেস্টা করতে হবে, ইতিবাচক চিন্তা, সৃজনশীল কাজ, ভালো বন্ধুত্ব, শখের কাজ মানসিক প্রশান্তি জোগায়, মন ভালো রাখে ও চাপ কমায়।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বির মাত্রা সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সঠিক ওজন বজায় রাখার চেস্টা করতে হবে।
নিয়মিত ভালোভাবে চুল আঁচড়াতে হবে। তাহলে চুলের গোড়ায় পুষ্টি সরবরাহ হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম, বা শারিরিক কসরত করতে হবে। তা না পারলে সময় পেলেই হাঁটতে হবে। এতে শরীরের সব অঙ্গে রক্ত সরবরাহ হয় ফলে শরীর সুস্থ থাকে।
স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে গোসল করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চুলে কলপ, রাসায়নিক ব্যবহার করা অনুচিত। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী, মানহীন বিউটি পারলার থেকে সেবা গ্রহণ না করাই উত্তম।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া রূপচর্চার জন্য কোনো ওষুধ সেবন করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
আশাকরি উপরের নিয়মগুলো মেনে চললে অসময়ে চুল পাকা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আমাদের উচিত ক্ষতি হওয়ার আগেই নিয়ম মেনে জীবন যাপনের মাধ্যমে নিজেকে ফিট রাখা।
এটিও পরতে পারেনঃ চুল পড়ার কারণ ও করণীয়
নতুন চুল গজানোর উপায়
সোর্সঃ https://www.shajgoj.com/5-tips-stop-graying-hair/
https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/%E0%A6%85%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A3