চা বাসর । একটি হৃদয় প্রশান্তকারী গল্প

আমি কখনোই কাজিন ম্যারেজে বিশ্বাস ছিলাম না। পছন্দও করতাম না। আমার স্ত্রীও আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে মোটেও পছন্দ করতো না। কপালের লিখন যায় না খণ্ডন। আমাদের বিয়ে হয়েছে। না, আমাদের মধ্যে তথাকথিত বিবাহপূর্ব হারাম সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্ক থাকবে কী, দুজনের সম্পর্কটা ছিল রীতিমতো সাপেনেউলে। আমরা একে অপরকে ভীষণ অপছন্দ করতাম। ছেলেবেলা থেকেই আমাদের ঝগড়া লেগে থাকত। ছেলেবেলায় একদিন ঝগড়া করতে গিয়ে বলে ফেলেছিলাম, তোর মতো মেয়েকে আমি জীবনেও বিয়ে করব না। সেও কম যায় কি সে, পাল্টা জবাব দিয়েছে, আপনার মতো লোকের বউ হতে আমার বয়েই গেছে।

ঝগড়াযুদ্ধ অবস্থাতেই চাচাজান বদলি হয়ে গেলেন। দুজনের দেখাসাক্ষাত বন্ধ হয়ে গেল। দুই পরিবার দেশের দুই প্রান্তে। ঈদে-চাঁদে দাদা-দাদুর কাছে এলেও কেউ কারো মুখ দেখতাম না। আগের সেই ঝগড়ার রেশ তখনো রয়ে গিয়েছিল। পরিবারের কেউ দুজনের মান ভাঙাতে এগিয়ে আসেনি।

ঝামেলা পাকালো বুড়ি দাদিজান। তিনি গোঁ ধরলেন, আমাদের দুজনের বিয়ে না হলে নাকি, তিনি মরেও সুখ পাবেন না। দুই পুত্রের কাছে সমন পাঠালেন। জরুরি তলব পেয়ে দুই সুবোধ পুত্র হাজির। হুকুম জারি হল, মীর ও সামিরার বিয়ে দিয়ে দে। মায়ের বার্তা নিয়ে দুই পুত্র যে যার বাড়িমুখো হল। প্রস্তাব শোনামাত্রই পাত্র ও পাত্রী দুজনেই লাফিয়ে উঠল: অসম্ভব, এই বিয়ে কস্মিনকালেও হতে পারে না। জীবন গেলেও না। না। না। না।

নাতি-নাতনির অনঢ় অবস্থান দেখে বুড়ি আপন সিদ্ধান্তে আরো অটল হয়ে গেলেন। এই বিয়ে হতেই হবে। দুই পরিবার এবার পাত্র ও পাত্রীর মতামত চেয়ে অযথা সময় নষ্ট করল না। সরাসরি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল: এই বিয়ে হবে। ছেলে দেশ ছেড়ে প্রবাসী হওয়ার হুমকি দিল , মেয়ে বিষ না কী খাওয়ার হুমকি দিল। বুড়ি এসব শুনে বলল: যে বিদেশ যাবে, সে ফিরে আসার পর বিয়ে হবে। যে মরে যেতে চায়, তার লাশের সাথেই বিয়ে হবে।

কোনো বাধাই ধোপে টিকল না। দুই পরিবারের সম্মিলিত তোড়জোড়ে বর-কনে জোয়ারের মতো ভেসে গেল। বিয়ের আগে দুজনের কেউই দেখা করতে রাজি হয়নি। যে যার গোঁ ধরে থাকল। মীর দুরুদুরু বুকে বাসরে প্রবেশ করল। সে আসতে চায়নি। কাজিনরা জোর করে ধরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মীর ভেবেছিল সামিরাকে খাটের ওপর ঘোমটা দিয়ে তার অপেক্ষায় বসে থাকতে দেখবে। আবার ভেবেছিল, সারাদিনের ধকলে সামিরা ঘুমিয়ে পড়বে। তাহলে সে সুযোগ বুঝে বাইরে কোথাও রাত কাটাবে। মীর বুঝতে পারছিল, তার মতো সামিরাও পরিবারের কাছে অসহায় হয়ে বিয়ে বসেছে। আবার এই শংকাও মনে জাগছিল, প্রবেশ করার সাথে সাথেই বাসর ঘর রণক্ষেত্রে পরিণত হবে।

প্রবেশ করার পর মীরের দুচোখ ছানাবড়া। এতক্ষণ কীসব ভেবে এসেছে আর এখন কী দেখছে। সামিরা জায়নামাজে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে। মীর ভাবল, সবার চাপে বিয়েটা হয়েছে। তাই অক্ষম বোবা কষ্টে এভাবে আকুল হয়ে কাঁদছে। তারপরও ছোটবেলা থেকে যে সামিরার ছবি মনে আঁকা ছিল, তার সাথে এই সামিরাকে মেলাতে পারছিল না। তার কান্না দেখে মীরের ভেতরটাও আর্দ্র হয়ে উঠল। বেচারি নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে, মা-বাবা, ভাইবোন ছেড়ে আমার বাড়ি এসেছে, আমার উচিত আগের তিক্ততা ভুলে দুজনের সম্পর্কটাকে সিক্ত করে তোলার প্রয়াসী হওয়া। মীর তাকে নিজের সামনে মাথা নোয়ানো দেখতে চেয়েছিল। এখন সামিরাকে আল্লাহর সামনে এভাবে মাথা নোয়াতে দেখে, মীরের মনে হল, হয়তো তার সামনেও আগের মতো ফনা তুলবে না। এসব ভাবতে ভাবতে মীর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সামিরার প্রতি এতদিন যে অনীহা ছিল, সেটা কীভাবে যেন কেটে গেছে। তার জায়গায় সামিরার প্রতি কেমন এক ধরনের সুতীব্র মায়াময় টান অনুভব করতে লাগল। মীরের মনে পড়ল, সামিরা চা-রসিক। ভালো চায়ের প্রতি সামিরার সীমাহীন দুর্বলতা।

মীর চুপিসারে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল। সামিরা চা খেতে পারে, এই চিন্তা থেকে পাশের খালি কামরায় আগেই চায়ের সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দক্ষ হাতে দুই কাপ চা বানিয়ে ফিরে এল। ততক্ষণে সামিরার নামাজ শেষ। জায়নামাজে বসে আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছে। মীরকে চায়ের পেয়ালা হাতে প্রবেশ করতে দেখে, দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। মীরও সালাম দিয়েছিল। দুজনের সালাম আর উত্তর প্রায় একসাথে উচ্চারিত হল। মীর মিষ্টি মদির বাসরহাসি দিয়ে আদর-মমতাপূর্ণ ভঙ্গিতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিল। সামিরা দুহাত বাড়িয়ে সসম্মানে চায়ের পেয়ালা হাতে নিল। দুজনেই একসাথে চুমুক দিল। সামিরা ছোটবেলা থেকেই চায়ে চুমুক দেয়ার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলে। আজও তাই করল। প্রথম চুমুক সময় নিয়ে পান করল। তার চেহারায় অপূর্ব এক জ্যোতি ফুটে উঠল। মীর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ফিসফিস করে বলল, “একচাপ চায়ের’ এতই শক্তি, দীর্ঘদিনের শত্রুকেও বন্ধু বানিয়ে দিল?”

মীরের প্রশ্ন শুনে সামিরা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, দেশী চায়ের রূপ-রস-গন্ধই অন্যরকম। বিদেশী জালেমের চা কেনা বাদ দিয়ে যে মানুষ “দেশি পণ্য কিনে হই ধন্য” স্লোগান দিয়ে দেশি ‍‘চা’ কেনে ও নিজের হাতে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে পরিবেশন করে, তার সাথে শুধু বন্ধুত্ব কেন, আরো অনেক ‘কিছু’ হওয়া সম্ভব!

এখান থেকে মূল মেসেজটা খুজে বের করুন পারলে।

লেখাটি ফেইসবুকে লিখেছেন Atik Ullah হযরত।

আরো পরুনঃ প্রযুক্তি আমাদের কাজকে সহজ করলেও আমাদের ব্যস্ততা কমছেনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *