গত পর্বে আপনাদের সাথে আলোচনা করেছি ছাদে বাগান করার উপকারীতা নিয়ে। আশা করি উপকারীতা গুলো জেনে অনেকেই ছাদে বাগান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে শুরু করবেন তা বুঝতে পারছেন না। তাদের জন্য সহজে ছাদ বাগান করার সম্পূর্ণ গাইডলাইন নিয়ে আমার আজকের এই আলোচনা। আশা করি পুরো লিখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়বেন এবং এখান থেকে প্রাপ্ত আইডিয়া দিয়ে সাজিয়ে নিবেন আপনার ছাদ বাগান।
ছাদ বাগান করার পদ্ধতিসমূহ
টবের মাধ্যমে ছাদ বাগান
ছাদে গাছ লাগানোর অন্যান্য পদ্ধতি থাকলেও সহজে স্থানান্তর যোগ্য বলে সকলের পছন্দনীয় হচ্ছে টব। আমরা সবাই জানি, বেশীরভাগ ফলগাছই আকারে বড় হয় বিধায় টব ফল গাছের জন্য কম উপযোগি। কিন্তু ফল গাছের কলম এবং যেই ফল গাছ গুলো আকারে বেশী বড় হয় না সেগুলো টবে লাগানো যায়। বাজারে পোড়ামাটির টব এবং বিভিন্ন কালারের প্লাস্টিকের টব পাওয়া যায়, দুটির মধ্যে পোড়ামাটির টব বেশী ভালো। এছাড়া সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এটির গায়ে নিজের ইচ্ছেমতো রং করিয়ে নেওয়া যায়। আর যদি টবে বড় আকারের গাছ লাগাতে চান তাহলে সিমেন্ট দিয়ে বড় টব বানিয়ে নিতে হবে।
হাফ ড্রামের মাধ্যমে ছাদ বাগান
ছাদে ফলের বাগান করার জন্য এই পদ্ধতি খুবই উপযোগী। শাক-সবজি, ফুলের জন্য ছোট খাট টব বা পাত্র হলেও চলে। কিন্তু ফলের ক্ষেত্রে পাত্র/ড্রাম যত বড় হয় তত ভালো। মনে রাখতে হবে গাছ ভবিষ্যতে যত বড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে তা মাথায় রেখে পাত্র নির্বাচন করতে হবে। হাফ ড্রাম পদ্ধতিতে খেয়াল রাখতে হবে যেন ভিতরে পানি জমে না যায় তাই ড্রামের তলদেশে কিছু ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে এবং ছিদ্রগুলো ইটের কণা অথবা টবের ভাংগা অংশ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর ড্রামের নীচে এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ইটের কণা দিয়ে তার উপর হালকা বালি দিয়ে দিতে হবে। তারপর এক ইঞ্চির মতো যায়গা জৈব সার বা পঁচা গোবর দিয়ে ভরতে হবে৷ এর উপর মাটি দিতে হবে৷ এতে করে সহজের অতিরিক্ত পানি ড্রাম থেকে বের হয়ে যেতে পারবে।
চৌবাচ্চার মাধ্যমে ছাদ বাগান
এক/দেড় ফুট উঁচু এবং তিন/চারটি পিলারের উপর পানির ট্যাঙ্ক বা চৌবাচ্চা আকারের রিং স্লাব বসিয়ে ইটের টুকরো এবং সিমেন্টের ঢালাই দিয়ে স্থায়ী চৌবাচ্চা তৈরি করা যায়। চৌবাচ্চার আকার অনুযায়ী চারা নির্বাচন করতে হবে। একটি কথা বার বার মাথায় রাখতে হবে, আপনি ভবিষ্যতে চারা যতটা বড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে তার কথা মাথায় রেখে পাত্র নির্বাচন করতে হবে। অবশ্য যদি ভুল হয়ে যায় তাহলে গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে পাত্র খুব সাবধানতার সহিত চেঞ্জ করতে হবে যেন গাছ কোন আঘাত না পায়।
স্থায়ী বেড পদ্ধতিতে ছাদ বাগান
ছাদ বাগানের জন্য সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে স্থায়ী বেড। তবে এই পদ্ধতি সঠিক ভাবে করতে না পারলে ছাদের স্থায়িত্ব নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য হয়তো ছাদে বিশেষ ভাবে ঢালাই দিয়ে নেট ফিনিশ ঢালাই করে নিতে হবে অথবা বেড এবং ছাদের মাঝে একটু যায়গা রেখে উচুতে স্লাব বসিয়ে নিতে হবে৷ এতে ছাদের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। স্থায়ী বেড ছাদের চারদিকে অথবা মাঝখানেও সারিবদ্ধ ভাবে করা যায়। এজন্য চারদিকে দুই থেকে আড়াই ফুট প্রস্থের এবং দেড় থেকে দুই ফুটের উঁচু দেওয়াল তুলে নেট ফিনিশ ঢালাই দিতে হবে। অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷ তারপর হাফড্রাম পদ্ধতির মতো প্রথমে ইটের কনা, বালি দিয়ে তারপর তার উপরে জৈব সার/ পঁচা গোবর দিতে হবে। সবশেষে মাটি এবং গোবরের মিশ্রন দিয়ে বেড পূর্ণ করতে হবে।
ছাদ বাগানে সারের ব্যবহার
যেহেতু টব পদ্ধতিতে মাটি কম থাকে তাই টবে চাষ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জৈব সার ব্যবহার করা উচিত। ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি আকারের প্রতিটি টবের জন্য জৈব সারের সাথে ৮০-১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৪০-৫০ গ্রাম এমওপি সার মিশিয়ে ১-২ সপ্তাহ বাড়িতে রেখে দিতে হবে। তারপর টব ভরাট করতে হবে। আর ড্রাম পদ্ধতিতে জৈব সারের পাশাপাশি প্রতিটি ড্রামে ২০০-২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০-১৫০ গ্রাম এমওপি ব্যবহার করা যায়। নার্সারিতে সারের মিশ্রণ এবং সার মিশ্রিত মাটি কিনতে পাওয়া যায়, ছাদ বাগানের প্রথম দিকে ওই সোর্স থেকে সংগ্রহ করতে পারেন মনে রাখতে হবে সার পর্যাপ্ত পরিমাণে হতে হবে। বেশী সার যেমন গাছের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তেমনি কম সারে গাছ পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।
ছাদ বাগানের জন্য গাছ নির্বাচন
ছাদ বাগান আপনার তাই আপনার পছন্দই এখানে বেশী প্রাধান্য বিস্তার করবে। তবে মনে রাখতে হবে বেশী বড় হয় এমন গাছ নির্বাচন করা যাবে না। আকারে ছোট, দ্রুত ফলন পাওয়া যায় এবং অধিক সময় ধরে ফলন পাওয়া যায় এমন গাছ নির্বাচন করতে হবে। বীজ চারা যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে কলম চারা দিয়ে ছাদ বাগান করা সবচেয়ে উপযোগী।
ফলের গাছ: আম, পেয়ারা, বিভিন্ন জাতের লেবু, মাল্টা, কুল, কমলা, সফেদা, ডালিম, শরিফা, আমলকী, আমড়া, ড্রাগন ফল, করমচা, বিলিম্বি, জামরুল এবং আপনার পছন্দমতো দেশী বিদেশি অনেক গাছের কলম লাগাতে পারেন৷
শাকসবজি: শসা, বরবটি, শীম, ঢেড়স, টমেটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, মূলা, কলমি শাক, পুইশাক, ডাটাশাক, লালশাক, সজিনা, লাউ, ধুন্দল, করলা ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে।
এখানে দেখে নিনঃ ছাদে সবজি চাষ করার সহজ পদ্ধতি
ফুল গাছ: গোলাপ, শিউলি, বেলী, টগর, জুই, গন্ধরাজ, জবা, এলামন্ডা, চায়না বেলী এবং অন্যান্য বিদেশি ফুল গাছ ও মৌসুমী গাছ লাগানো যেতে পারে।
ঔষুধী গাছ: তুলসী, অ্যালোভেরা, থানকুনি, নিম, চিরতা, গাইনোরা ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে।
মসলা জাতীয় গাছ: মরিচ, ধনিয়া, পুদিনা, আদা, রসুন, পেয়াজ ইত্যাদি গাছ লাগানো যেতে পারে।
ছাদ বাগানের পরিচর্চা
যেহেতু সীমিত আকারে, সীমিত জায়গায় উৎপাদন করা হয় সেজন্য অতিরিক্ত যত্ম সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিভিন্ন পরিচর্যায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ফল এবং ফুল গাছ গুলোর হেলে পড়া আটকাতে হবে। কেননা হেলে পড়লে অথবা নড়ে গিয়ে গাছ দূর্বল হয়ে যেতে পারে। এজন্য কাঠি দিয়ে গাছকে সোজা করে রাখতে হবে। আগাছা পরিষ্কার করতে হবে এবং ছাদ বাগানের পরিবেশ অবশ্যই সুন্দর রাখতে হবে। সময়মতো গাছে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং অবশ্যই অতিরিক্ত পানি টব থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক থেকে দেড় বছর পর পর পুরাতন মাটি বদলিয়ে জৈব সার যুক্ত নতুন মাটি দিতে হবে। গাছপালায় যেন রোগ জীবাণু আক্রমণ না করে সেজন্য নিয়ম অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। গুটি স্যার পানিতে মিশিয়ে গাছে হালকা করে ছিটিয়ে দিতে হবে।
সাবধানতাঃ
-ছাদ বাগানের ক্ষেত্রে প্রথমে ছোট গাছের সারি এবং পিছনে বড় বা লম্বা গাছের সারি রাখতে হবে।
-পিপড়ার উপদ্রব যেন না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এজন্য গাছের গোড়ায় খৈল দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
-বাজারে প্যাকেটে করে কম্পোস্ট সার বিক্রি করে৷ সেটা ব্যাবহারে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
– বিভিন্ন ধরনের সার যেমন মিশ্র সার, গুটি ইউরিয়া, হাড়ের গুড়া ইত্যাদি পচিয়ে ব্যবহার করলে অধিক ফল পাওয়া যায়।
– দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর পর গাছের গোড়ায় চুনের পানি ব্যবহার করা যায়।
– এক থেকে দেড় বছর পর পর মাটি বদল করে দিতে হবে।
আশা করি উপরের তথ্যগুলো আপনাদের অনেক উপকারে আসবে উপরের গাইডলাইন ফলো করে আপনারা সহজেই একটি বাগান তৈরী করে ফেলতে পারবেন।
ছাদ বাগানের টবের মাটি তৈরির পদ্ধতি
ছাদে বাগান করার কৃষি উপকরণ